অগ্নিকান্ড, শর্ট সার্কিট ও গ্যাস লিকেজ থেকে কীভাবে ঘরকে রাখবেন নিরাপদে
ঘর মানে কারো কাছে ভালবাসা, কারো কাছে আশ্রয়, আবার কারো কাছে নিরাপত্তা। ঘরের সংজ্ঞাটা যেমনই হোক না কেন, প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে ঘরে কাটানো সময়গুলো সবসময়ই আনন্দের। অথচ এই আনন্দে ভাঁটা পড়ে শোক নেমে আসতেও সময় লাগে না, যদি ঘরের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না হয় শুরু থেকেই। বিশেষত, সমসাময়িক কিছু দুর্ঘটনা আমাদেরকে বার বার করছে আতঙ্কগ্রস্ত। ঘরের মাঝে থেকেও পরিবারের মানুষগুলো সুরক্ষিত তো? এমন প্রশ্নে যেন এ শহরবাসী স্বস্তি খুঁজে পায় না কিছুতেই।
অথচরগ্যাস লিকেজ, অগ্নিকান্ড বা শর্ট সার্কিটের মত দুর্ঘটনা গুলো হরহামেশাই ঘটছে আমাদের অসাবধানতার কারণে। তাই অগ্নিকাণ্ড, গ্যাস লিকেজ, শর্ট সার্কিটের মতো দুর্ঘটনাগুলো এড়াতে আগে থেকেই আমাদের সচেতন হতে হবে, নিতে হবে কার্যকরী ব্যবস্থা। তাই, কীভাবে নিশ্চিত হবে আমাদের ঘর এবং ঘরে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর নিরাপত্তা, সেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোই চলুন জেনে আসা যাক আজকের লেখায়।
অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে করণীয়
অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। তাই অগ্নি প্রতিরোধে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে ঘরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে লক্ষ্য রাখুন এই বিষয়গুলো-
১। রান্নার পর চুলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলুন।
২। বিড়ি বা সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলুন।
৩। খোলা বাতির ব্যবহার কমিয়ে দিন।
৪। ঘরে ও কলকারখানায় অগ্নি নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পানি সবসময় সংরক্ষণ করুন।
৫। ছোট ছেলেমেয়েদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে।
৬। অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে নিয়মিত ভবনের বৈদ্যুতিক কেবল ও ফিটিংস পরীক্ষা করুন।
৭। বাসগৃহ, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপণী যন্ত্রপাতি স্থাপন করুন এবং জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করুন।
৮। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে অগ্নি প্রতিরোধ, অগ্নি নির্বাপণ, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন। এটাই বিপদকালীন সময়ে আপনাকে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
৯। যেকোনো ভবনকে নিরাপদ করতে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড অনুসরণের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সঠিক নকশা ও নির্মাণ পদ্ধতি অনুসরণ করে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
১০। হঠাৎ আগুন লাগলে যাতে তাৎক্ষনাত ফায়ার সার্ভিসে সেবা চাইতে পারেন এজন্য ৯৯৯ নম্বরটি সবসময় মোবাইল ফোনে সংরক্ষণ করুন।
শর্ট সার্কিট নিয়ন্ত্রণে করণীয়
![সুইচবোর্ড](https://www.bproperty.com/blog/wp-content/uploads/pexels-pixabay-257736-1.jpg)
সকল নিয়ম মেনে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ ভবন নির্মাণের পরেও যে দুর্ঘটনাটি ঘটার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি থাকে সেটি হল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। আর সবচাইতে ভয়াবহ বিষয় হল, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে মারাত্মক অগ্নিকান্ডের সম্ভাবনাও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে কমার্শিয়াল ভবন, এমন দুর্ঘটনার উদাহরণ রয়েছে অগণিত। এজন্যই বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার সময়ও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা ভীষণ জরুরি-
১। বৈদ্যুতিক সংযোগের সময় ক্যাবল বা তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। উন্নতমানের এবং অবশ্যই ব্র্যান্ডের তার ব্যবহার করতে হবে।
২। কেবল বাড়ির ডিজাইনের ক্ষেত্রেই নয়, আপনার বাড়ির দেয়ালের ভেতরে বা বাইরে দিয়ে আপনি যে বৈদ্যুতিক লাইন টানতে চান সেটিও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী করুন।
৩। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেকআপ। অনেক সময় বাড়ি নির্মাণের সময় সব ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও, কেবলমাত্র রুটিনমাফিক চেক-আপ না করার ফলে যে কোনো সংযোগ নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই ঝুঁকি এড়াতে ছয় মাস পরপর নিয়ম মেনে বৈদ্যুতিক সংযোগ চেক করুন।
৪। বৈদ্যুতিক ক্যাবল অথবা রুমের তাপমাত্রা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত গরম হয়ে যায় তবে তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিন। দ্রুত পরীক্ষা করে দেখুন কী কারণে এটি হচ্ছে।
৫। ঘরের যে কোনো বৈদ্যতিক যন্ত্র ব্যবহারের পর সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন।
গ্যাস লিকেজ এড়াতে করণীয়
![জলন্ত চুলা](https://www.bproperty.com/blog/wp-content/uploads/pexels-oleg-magni-3800512.jpg)
নিজের বাড়ি হোক বা ভাড়া বাসা, প্রিয় রান্নাঘরটি কীভাবে সাজাব, তা নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু এসবের ভীড়ে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই কিচেনে গ্যাসের চুলার যে লাইনটি সংযুক্ত, সেদিকে মনোযোগ দিতে। আপনার ঘরে যত রকমের হোম অ্যাপ্লায়েন্সই থাকুক না কেন, যে জিনিসটি না হলেই নয় তা হল গ্যাস স্টোভ। অথচ এই গ্যাসের স্টোভ থেকেই ঘটতে পারে সবচেয়ে বড় অঘটনটি। তাই ঘরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে লক্ষ্য রাখুন এই বিষয়গুলোতেও-
১। রান্নাঘরটি খোলামেলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। রান্নাঘরের জানালা সব সময় খোলা রাখতে চেষ্টা করুন।
২। রান্না শেষে গ্যাসের চুলার সুইচটি ঠিকভাবে বন্ধ হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত হোন।
৩। সংযোগ দেয়ার সময় মানসম্মত রাবার টিউব অথবা হোস পাইপ ব্যবহার করুন। রাবার টিউব অথবা হোস পাইপে সাবানের ফেনা লাগিয়ে লিকেজ চেক করুন।
৪। সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে গ্যাসের লাইনের সংযোগ দিন।
৫। গ্যাসের চুলার সংযোগ লাইনে কোনো লিকেজ আছে কিনা প্রতি বছর একবার করে চেক করুন।
৬। এলপিজি সিলিন্ডার হলে যদি সেটি গ্যাসহীন বা অব্যবহৃত অবস্থায় থাকে, তাহলে রেগুলেটরের নব বন্ধ করে রাখুন। চুলার পাশে আগুনের উৎস থেকে কমপক্ষে ২-৩ মিটার দূরত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় সিলিন্ডার রাখুন।
৭। কুকার কিংবা রান্নাঘরে চুলার কাছাকাছি কোন জানালায় পর্দা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কেরোসিন বা এই জাতীয় অন্যান্য যেকোন দাহ্য বস্তু গ্যাস সিলিন্ডার বা চুলার কাছাকাছি রাখবেন না।
৮। জরুরী অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য ইমারজেন্সি ফোন নাম্বার নাগালের মধ্যে রাখুন।
৯। বিভিন্ন ধরণের ইমারজেন্সির ক্ষেত্রে আপনার বাসা, বিশেষ করে রান্নাঘরের মধ্যে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি, যেমন- গ্যাস ডিটেক্টর, অগ্নি নির্বাপক ইত্যাদি কিনে রাখুন।
এতসব নিয়ম কানুন মেনে চলতে কিছুটা আলসেমি, কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা অনীহা আসতেই পারে। কিন্তু এটাও সত্যি আপনার ঘরের সুরক্ষা থেকে কোনো কিছুই বেশি জরুরি নয়। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা গ্যাস লিকেজ কিংবা এসব থেকে বড় আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা কয়েক মূহুর্তেই নষ্ট করে দিতে পারে ঘর আর ঘরের মানুষগুলোকে নিয়ে দেখা সোনালি স্বপ্ন। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই তাই প্রতিরোধ করুন শুরু থেকে। দুর্ঘটনা ঘটলেও যাতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে সেটি মোকাবেলা করা যায় সেটিও নিশ্চিত করুন। সেইসাথে, ঘরের সুরক্ষায় আপনি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, আমাদের জানিয়ে দিন কমেন্টে।
[ad_2]